সফল উদ্যোক্তার বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী কি কি?
একটি পণ্য, দ্রব্য, সংগঠন বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থাপনের প্রাথমিক উদ্যোগ যে গ্রহণ করে তাকেই মূলত উদ্যোক্তা বলা হয়। চাইলে উদ্যোক্তা যে কেউই হতে পারে। কিন্তু সবাই সফল উদ্যোক্তা হতে পারে না। একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া সহজ না। কিন্তু সেটা অসম্ভবও না।
আমাদের মাঝে অনেকেই আছে যারা সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে চায় কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে হয়ে উঠতে পারে না।
একজন সফল উদ্যোক্তা জানে, লক্ষ্য অর্জনের জন্য কতটা পরিশ্রম করা লাগে, কতটা ডেডিকেশন দিতে হয়। সময়ের সাথে তারা অনেক গুণ আর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে উঠে।
- সফল উদ্যোক্তারা সব সময় সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা করে।
- তারা যেকোনো খারাপ পরিস্থিতি সামলানো ও ব্যর্থতাকে সাদরে গ্রহণ করার সামর্থ্য রাখে।
- সাধারণত মানুষ যেখানে ব্যর্থতা দেখে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় সেখানে তারা ব্যর্থতার মাঝে নতুন কিছু শেখার সুযোগ দেখে।
- তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায় না। তারা সবসময় ভ্যালু ক্রিয়েট করার চেষ্টা করে। কারণ তারা জানে যে কেবল ভ্যালু প্রোভাইড করার মাধ্যমেই ক্রেতাদের মন জয় করে তাদের সাথে সার্বজনীন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে যাতে ভবিষ্যতে সেসব ক্রেতারা শুধু তাদের থেকেই পণ্য কিনে।
- এর মাধ্যমে তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা এই প্রতিযোগিতাপূর্ন বাজারে টিকে থাকার জন্য নিয়মিত নিজেদের মাঝে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করে।
তাদের এইসব গুণ আর বৈশিষ্ট্য যদি আমরা নিজেদের মাঝে নিয়ে আনতে পারি তাহলে আমরাও সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারব।
আর এটা করার জন্য আমাদের একজন সফল উদ্যোক্তার মতো করে ভাবা শিখতে হবে, উদ্যোক্তা মাইন্ডসেট গড়ে তুলতে হবে।
উদ্যোক্তাদের মন ও চিন্তা ভাবনা কেমন ?
সফল উদ্যোক্তাদের খুব শক্তিশালী মাইন্ডসেট থাকে। তারা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পছন্দ করে৷ তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজন মোতাবেক নিজেদের কন্ডিশনে পরিবর্তন আনে।
যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিয়ে সাফল্য অর্জন করার মতো আত্মবিশ্বাস তাদের থাকে। তাদের মাইন্ডসেটই তাদের সাফল্য এনে দেয়।
উদ্যোক্তা মাইন্ডসেট হচ্ছে সেই চাবিকাঠি যেটা আপনাকে সাফল্য পেতে সাহায্য করবে। প্রতিকূলতা, ভুল আর হতাশা এইসব হচ্ছে একজন সফল উদ্যোক্তার জন্য নতুন স্কিল শেখার সুযোগ যা তাকে ভবিষ্যতে সমৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে।
উদ্যোক্তা হতে হলে কি করবেন?
আপনাকে একজন সফল উদ্যোক্তার মতো ভাবা শুরু করতে হবে। তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করতে হবে। যে যে গুন আয়ত্ত করতে পারলে আপনি উদ্যোক্তা মাইন্ডসেট গড়ে তুলতে পারবেন তা নিচে দেওয়া হলোঃ
১) ইতিবাচক মনোভাব ও আত্মবিশ্বাস রাখা
একটা সফল প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য সঠিক মনোভাব থাকাটা খুবই জরুরি। ব্যবসা শুরুর সময় এটা মনে রাখতে হবে যে, ব্যবসা করতে গেলে পথে ঝুঁকি আসবেই।
আর এ ঝুঁকি মেনে নেবার মত মন-মানসিকতা থাকতে হবে। সবসময় ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সংশয় সবার মনেই জন্মায়।
সেটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তা জানা থাকলে আপনি অবশ্যই একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারবেন। একই সাথে নিজের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে।
আপনাকে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে আপনি সব বাধাঁ অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যে অবশ্যই পৌঁছাতে পারবেন।
যদি নিজের উপর আস্থা না থাকে তাহলে সফলতা কখনোই হাতে আসবে না। সবসময় শুরুটা হবে নিজেকে দিয়ে। “আমি পারবই”— এই মানসিকতা নিয়ে এগুতে হবে।
২) সময়ের সদ্ব্যবহার করুন
একজন ব্যবসায়ীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার সময়। যে সময়ের সঠিক ব্যবহার করতে পারবে সে সফল হবে আর যে পারবে না তার নাম উঠবে ব্যর্থতার খাতায়।
আমরা ব্যর্থ উদ্যোক্তা হতে চাই না। সফল উদ্যোক্তা হতে হলে আপনাকে ঠিকমতো পরিকল্পনা করার মাধ্যমে সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ ৫ টি সেরা টাইম ম্যানেজমেন্ট টিপস
অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। তাই ভেবেচিন্তে নিজের দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর প্ল্যান করুন।
নিজের সময় কার সাথে এবং কীভাবে ব্যয় করবেন তা নিয়ে ভাবুন; কারণ এটাই হয়তো ঠিক করে দিবে আপনি সফল হবেন নাকি ব্যর্থ। মনে রাখবেন আপনার সময় অনেক সীমিত তাই সেটার অপচয় করা যাবে না।
৩) লক্ষ্য ঠিক করুন
সফল হবার জন্য আপনার একটা পরিষ্কার লক্ষ্য থাকা লাগবে। একজন সফল উদ্যোক্তা শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের লক্ষ্যে অটল থাকে।
আর সেটা ঘটে কারণ তাদের একটা পরিষ্কার ভিশন থাকে। তারা কী অর্জন করতে চায় সেটা শুরু থেকেই ঠিক করে রাখে৷ লক্ষ্য ছাড়া উদ্দেশ্যহীনভাবে কাজ করে গেলে কখনোই সফল হতে পারবেন না।
তাই আগে মনে মনে আপনার লক্ষ্যের এক দৃশ্যকল্প তৈরি করুন। কীভাবে সবকিছু পরিচালিত করতে চান তা ঠিক করুন। সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করুন। লক্ষ্য মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ঠভাবে এগুতে থাকুন।
৪) স্বপ্ন দেখুন
আমার মতে সফল উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে যে তাদের মাঝে সীমাহীন উদ্দীপনা থাকে। স্কুল-কলেজে আমাদের বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী হতে শেখানো হয়।
কিন্তু বড় স্বপ্ন দেখাতে ক্ষতি কী? নিজের স্বপ্নকে কোনোকিছু দ্বারা সীমাবদ্ধ করবেন না। একজন মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হয়ে থাকে।
“যদি কিছুর স্বপ্ন দেখতে পারেন, আপনি সেটা করতেও পারবেন।”
ওয়াল্ট ডিজনি
তাই বড় স্বপ্ন দেখাকে ভয় পাবেন না। আপনাকে অনেক খাটতে হবে, অনেক আত্মত্যাগ দিতে হবে কিন্তু পরিশেষে যখন ফল পাবেন তখন সব কষ্ট, সব আত্মত্যাগ উসুল হয়ে যাবে।
প্রথমে আপনার প্রত্যাশিত ফলাফল নিয়ে ভাবুন এবং তারপর সেটাকে কীভাবে অর্জন করা যায় তা নিয়ে ভাবা শুরু করুন।
যদিও সব আইডিয়াকে হয়তো বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব হয় না কিন্তু আপনাকে ঝুঁকি নিতে হবে, প্রস্তুত থাকতে হবে এবং নিজের আইডিয়ার উপর বিশ্বাসী হতে হবে। শুরুতে সেটাকে যতই অসম্ভব মনে হোক না কেন, হাল ছাড়লে চলবে না।
৫) কঠোর পরিশ্রম করা
একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে পরিশ্রমী হতে হবে। অধিক পরিশ্রম করার মানসিকতা রাখতে হবে। কোনোকিছুই রাতারাতি হয় না।
একদিনে আপনি সফল হতে পারবেন না। আমরা সফল মানুষদের দিকে তাকায় আর ভাবি যে ওরা কত সহজেই জীবনে সফল হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই ধারণাটা পুরোপুরি ভুল। প্রত্যেকের সাফলতার পিছে থাকে অগণিত পরিশ্রম। ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে সাফল্য হাতে আসবে না।
কঠোর পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য নিজেকেই বানাতে হবে। একইসাথে আপনাকে হতে হবে সৃজনশীল। সফল উদ্যোক্তারা সবসময় নতুন স্কিল শিখতে থাকে, নতুন জ্ঞান অর্জন করে, এবং সবসময় নিজের বিকাশের জন্য কাজ করতে থাকে।
একজন সফল উদ্যোক্তা সকল কাজে নিজের সবটুকু ঢেকে দেয়। আপনি চেষ্টা চালিয়ে যান, সাফল্য এক না একসময় আপনাকে ধরা দিবেই। যদি যথেষ্ট পরিশ্রম করেন তাহলে যা হতে চান নিজেকে সেটা অবশ্যই বানাতে পারবেন।
৬) ঝুঁকি নিতে হবে
“No risk no gain” এই প্রবাদটা নিশ্চয় আমরা সবাই শুনেছি। আপনি যখন ঝুঁকি নেবেন, হয়তো আপনি জিতবেন না হয় কিছু শিখবেন।
ঝুঁকি নেবার মন-মানসিকতা উদ্যোক্তাদের বাকি সব পেশাদারদের থেকে আলাদা করে। একজন সাধারণ মানুষ সবসময় ঝুঁকি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
কিন্তু আপনার মাঝে যদি ঝুঁকি নেবার প্রবণতা না থাকে তাহলে এই পথে আপনার না হাটাই ভাল। তবে যে আপনি সব ধরনের ঝুঁকি নিবেন এমনটা না। একজন সফল উদ্যোক্তা জানে কোন ঝুঁকি নিতে হবে এবং কোনটা এড়াতে হবে।
৭) ব্যর্থতাকে ভয় না পাওয়া
ব্যর্থতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষক। একজন সফল উদ্যোক্তার মতো ভাবা শিখতে হলে আপনাকে ব্যর্থতাকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে।
সফলতা ও ব্যর্থতা হচ্ছে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর দশটা লোকের মতো ব্যর্থতাকে ভয় পেলে চলবে না।
আপনাকে সেটাকে সাদরে গ্রহণ করা শিখতে হবে। কারণ একজন সফল উদ্যোক্তার জন্য ব্যর্থতা হচ্ছে নতুন কিছু শেখার সুযোগ।
যেটা তাদের সাফল্যের পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। ইলন মাস্কের ভাষায়, “জীবনে ব্যর্থতা না আসলে তুমি সত্যিকার অর্থে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারবে না।”
পরিশিষ্ট
একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠার জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস, মানসিক স্থিতিশীলতা ও প্রচেষ্টা।
উদ্যোক্তা হবার কোনো বয়স বা কাল নেই। যে কেউ যেকোনো সময় নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। শুধু মনে রাখতে হবে যে সফল উদ্যোক্তা হবার জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করে যেতে হবে।