মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কী বোঝায়?
প্রথমে প্রশ্ন উঠতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য আসলে কী? মানুষের চিন্তা ,আবেগ ও আচরণ এই তিন মিলেই হল মানসিক স্বাস্থ্য। এটা আমাদেরই একটা অংশ কিন্তু আমরা এটার উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিই না।
আপনি কি জানেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে, বিশ্বে একজন মানুষ মানসিক অসুস্থতার কারণে আত্মহত্যা করে। নিজের দেহকে সুস্থ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু আপনাকে আগে নিজের আত্মার যত্ন নিতে হবে। আমাদের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য হচ্ছে দুই জমজ ভাইয়ের মতো।
একজনের কোনো ক্ষতি হলে অন্যজনের উপর তার প্রভাব পড়ে। শারিরীক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার মাধ্যমে জীবনে শক্তিশালী ও সফল হয়ে উঠতে পারবেন।
তাই, যদি সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে চান তাহলে দেহের সাথে মনেরও যত্ন নিতে হবে। আমরা নিচে কিছু নির্দেশিকা উল্লেখ করেছি যা আপনাকে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে ২৬ কোটিরও বেশি মানুষ মানসিক রোগ বা ডিপ্রেশনে ভুগছে।
যদি সেই তালিকাতে নিজের নাম উঠাতে না চান তাহলে আজ থেকেই নিচের নির্দেশিকা মেনে চলা শুরু করুন।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন কিভাবে করবেন?
১) প্রার্থনা
বিশ্বের প্রত্যেক ধর্মে প্রার্থনার বা উপাসনার নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি আছে, তাই না? মুসলিমরা দিনে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, হিন্দুরা পূজা করে, খ্রিস্টানরা গির্জাতে যায় এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
এটা জেনে হয়তো আশ্চর্য হবেন, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, আপনি যে ধর্মের-ই হোন না কেন, নিজ ধর্মের উপাসনা পদ্ধতি ঠিকভাবে ও নিয়মিত পালন করলে তা আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নিয়মিত নামাজ পড়লে আপনার চাপ, ক্রোধ, ভয় কমে যাবে এবং আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন করবেন।
তাছাড়া, ঈশ্বরের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে আপনার মন আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠবে এবং যেকোনো বাঁধার বিরুদ্ধে লড়ার শক্তি নিজের মাঝে খুঁজে পাবেন।
তাই আজ থেকেই নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করা শুরু করুন এবং একটা সুন্দর আগামীকে উপভোগ করুন।
২) সামজিক মাধ্যমের ব্যবহার
আজকের দুনিয়াতে কেউ কি আছে যার ফেসবুক আইডি নেই? প্রায় সবার আছে। সত্যি বলতে ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব মুস্কিল।
আমরা শুধু ফেসবুকের কথা বলছি না, সকল ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ার কথা বলছি যার দ্বারা আপনি নিজেকে বাকি বিশ্বের সাথে যুক্ত রাখেন।
আরও পড়ুনঃ প্রফেশনাল ইমেইল লেখার A to Z নিয়ম কানুন
এই যুগের অসাধারণ সব প্রযুক্তি যে মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে আসতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনে সেটার নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছে।
গবেষণা মতে, এসব যোগাযোগ মাধ্যমে, মানুষ শুধু নিজের সে রূপটা তুলে ধরে যা তারা অন্যকে দেখাতে চায়, যেটা কিনা উদ্বেগজনক।
অন্যদিকে, মানুষ ক্রমাগত নিজেকে এমন একটা ভার্চুয়াল দুনিয়াতে উন্মুক্ত করে ফেলছে যেখানে সবাই শুধু মনোযোগ, খ্যাতি ও স্বীকৃতির পিছে দৌড়াচ্ছে।
অন্যের পছন্দ অনুযায়ী তারা নিজের জীবনকে আকৃতি দিচ্ছে। এই অভ্যাস তাদের জীবনে খুব ভয়ানক প্রভাব ফেলছে।
ক্রমাগত অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করার ফলে আমাদের আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে এবং সেটা আমাদের ডিপ্রেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই, সচেতন হয়ে উঠুন এবং সামাজিক মাধ্যমের পিছে কম সময় ব্যয় করুন, বিনিময়ে ভবিষ্যতে অনেক ভালো ফল পাবেন।
সামাজিক মাধ্যমে কাটানোর জন্য দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখুন এবং তার চেয়ে এক মুহুর্তএ বেশি সেখানে ব্যয় করবেন না।
৩) পড়ার অভ্যাস
এটাকে হয়তো গতানুগতিক উপদেশ মনে হতে পারে। কিন্তু এদিকে শুনুন, নিজেকে স্মার্ট করে তোলার জন্য বই পড়ার বিকল্প অতীতে কখনো ছিল না, এখনো নেই এবং কখনো আসবেও না।
বই পড়া হচ্ছে মনকে ব্যায়াম করানোর মতো।
এই ২১ শতাব্দীতে ফোন, সামাজিক মাধ্যম, গেম, ও নেটফ্লিক্সের মতো প্ল্যাটফর্ম আমাদের জীবনে বই পড়ার অভ্যাসের আসন হয়তো দখল করে নিয়েছে কিন্তু কোনোকিছু কখনোই বই পড়ার উপকারিতাকে কমাতে পারবে না।
তাই, বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
- যদি বই পড়ার অভ্যাস না থাকে, তাহলে দিনে অন্তত এক পাতা করে পড়ুন এবং ধীরে ধীরে পাতা সংখ্যা বাড়াতে থাকুন।
- ছোট ছোট ধাপ ফেলে এগোলে তা আপনার উপর কোনো চাপ ফেলবে না এবং একসময় আপনার জীবনের অংশ হয়ে উঠবে।
৪) স্বার্থপর সময়
জীবনে চলার পথে উঠা-নামা লেগেই থাকবে, সেটা জীবনের একটা অংশ। যাদের মানসিক সক্ষমতা থাকবে তারা এসব বাঁধা পেড়িয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে, সফল হতে পারবে।
যদি নিজের সাথে সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকে তাহলে জীবনে আসা সকল অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে পারবেন।
কখনো ‘স্বার্থপর সময়’ শব্দটা শুনেছেন? হয়তো শোনেননি। আসলে, এটাই হচ্ছে Youth Rider ব্লগের বৈশিষ্ট্য, ক্যাম্পাস থেকে কর্পোরেট, শিক্ষা থেকে জ্ঞান, এখানে আপনি সেইসব অসাধারণ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন যার ব্যাপারে কথা বলার সামর্থ্য খুব কম প্লাটফর্মেরই আছে।
‘স্বার্থপর সময়’ বলতে দিনের নির্দিষ্ট একটা সময় শুধু নিজের জন্য সংরক্ষণ করাকে বুঝায়।
দিনে অন্তত ৫ টা মিনিট নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করুন, নিজের মধ্যে ঝেঁকে দেখুন।
সেই সময়ে, এমন কিছু করুন যা করতে আপনি খুবই উৎসাহী। সেটা হতে পারে, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, লিখালিখি অথবা অন্যকিছু। এভাবে আপনার ভেতরে থাকা মানুষটার সাথে পরিচিত হতে পারবেন।
কিন্তু আজকাল একান্তে ভালো সময় কাটানোর সক্ষমতাকে তরুণরা পছন্দ করে না। তাদের প্রাত্যহিক রুটিনে অন্য সবার জন্য সময় বরাদ্দ থাকে কিন্তু নিজের জন্য থাকে না।
নিজের সাথে স্বচ্ছ সম্পর্কের অনুপস্থিতি বিশৃঙ্খল মানসিকতার লক্ষণ, তাই সেই বাজে অভ্যাসকে কেটে ফেলার চেষ্টা করুন এবং নিজেকে সময় দিন।
৫) ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলা
হয়তো আপনার একজন আইডল আছে যার ব্যক্তিত্ব আপনার অনেক পছন্দ, যার মতো করে আপনি নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে চান।
যদি এমন কেউ থেকে থাকে তাহলে তাদের নিয়মিত অনুসরণ করা উচিত। তবে এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। একটা গল্প বলা যাক।
আরও পড়তে পারেনঃ কিভাবে ব্যক্তিগত সীমা নির্ধারণ করে অন্যকে খুশি রেখে চলা বন্ধ করবেন?
স্কুল জীবনে আমার এক বন্ধু ছিল। সালমান খানকে সে খুব পছন্দ করতো। সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যে বড় হয়ে সালমান খানের মতো হয়ে উঠবেই। তার মতো হয়ে উঠার জন্য এমন কিছু ছিল না যা সে করেনি।
সবসময় সে অভিনেতাদের মতো হাত-পা ছাড়িয়ে হাঁটতো, যদিও সেটা তার জন্য খুব অস্বস্তিকর ছিল। সেভাবে কাউকে অনুসরণ করার কথা আমরা বলছি না।
আপনাকে তাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে অনুসরণ করতে হবে এবং তাদের ভালো গুনকে গ্রহণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে, নিজ নিজ ধর্মীয় নেতাকে অনুসরণ করা উচিত, কারণ উনারা ছিলেন সব দিক দিয়ে আদর্শ এবং নিখুঁত।
এর মাধ্যমে আপনি নিজের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ গড়ে তুলতে পারবেন। যতো বেশি তাদের মতো হতে পারবেন নিজেকে ততো বেশি ভালোবাসতে শুরু করবেন এবং আত্ম ভালোবাসা সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্যের চাবিকাঠি।
৬) কৃতজ্ঞতা জানানো
অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় মানুষের আকাঙ্ক্ষা অসীম এবং এটা পুরোপুরি সত্য। একটা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে অন্য একটা তার জায়গা নিয়ে নেয় এবং অসুখী হবার পেছনে এটা একটা মূল কারণ।
আমরা এটা চাই, আমরা সেটা চাই, আমরা সবসময় আকাঙ্ক্ষা দ্বারা ঘিরে থাকি। এই ধরণের মানসিকতার ফলে ঈশ্বর যে আমাদের কতো কিছু দিয়েছেন তা আর দেখতে পাই না।
আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে যাই। নিজেকে প্রশ্ন করুন, শেষ কবে সবকিছুর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন?
মনে নেই, তাই না? বিশ্বাস করুন, কৃতজ্ঞতা জানানোর মাধ্যমে আপনার জীবন পাল্টে যেতে পারে। কৃতজ্ঞতা জানানোর মাধ্যমে আপনি অন্য মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন।
ঈশ্বর, পিতামাতা, ভাইবোন, বন্ধু, প্রতিবেশী যারা আমাদের তাদের ভালোবাসা ও যত্ন দ্বারা ঘিরে রেখেছে তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত।
তাহলে দেখবেন আপনার চারপাশে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন চলে এসেছে। প্রত্যেকদিন ঘুমাতে যাবার আগে সারাদিনে আপনার সাথে ঘটা ইতিবাচক ঘটনা গুলোর ব্যাপারে ভাবুন।
এই অভ্যাস আপনার জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিকে চিরতরের মতো পাল্টে দিবে।
“সুখ কোনো বাহ্যিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে আপনার মনোভাবের উপর।”
—- ডেল কার্নেগি
২০১৯ সালে করা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গিয়েছে যে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৭% মানসিক সমস্যায় ভুগে।
যার মধ্যে ১৬.৮% হচ্ছে পুরুষ এবং ১৭% হচ্ছে নারী। ৭-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ১৪% মানসিক সমস্যাতে ভুগে।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে তাদের মধ্যে ৯৪.৫% মানসিক সমস্যার জন্য কোনো চিকিৎসা নেয় না।
তাহলে বুঝতেই পারছেন বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্যকে কতোটা অবহেলার চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিবেচনায় করা হয় না।
আমাদের এটার উপর আলোকপাত করতে হবে। আমাদের সচেতন হয়ে উঠতে হবে।
নিজেরা মানসিক সমস্যায় ভুগলে তার ব্যাপারে অন্যদের জানাতে হবে, আশেপাশের কেউ এই সমস্যায় ভুগলে তাদের সাহায্য করতে হবে।
তাহলে, চলুন সবাই একসাথে নিজ নিজ মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য একটা ছোট্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করি।
Youthrider ব্লগের পক্ষে থেকে আপনাদের সবাইকে জানায় একটা সুখী, সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের শুভেচ্ছা।
ভালো থাকুন,সুস্থ থাকুন, সুখী থাকু এবং আমাদের সাথে থাকুন। মতামত দিতে ভুলবেন দয়া করে।